ভজন সরকারের দেশত্যাগের গল্পের বই : উত্তরের দেশে

0
57

সুকমল মোদক: গল্পগুলো দেশত্যাগের। গল্পগুলো শেকড় উপড়ানোর। গল্পগুলো অভিবাসনের; খুব সত্যি ক’রে বললে জোরপূর্বক অভিবাসনের। গল্পগুলোর ভেতর বয়ে চলে এক নিরন্তর কান্নার ফল্গুনদী। গল্পগুলো আমাদের উপমহাদেশ তো বটেই কখনও কখনও উপমহাদেশ ছাড়িয়েও বের করে আনে ধর্মীয় বিভাজন রেখার কঙ্কালসার অস্থিমজ্জা। গল্পগুলো তাই হয়ে ওঠে দেশত্যাগী সকল মানুষের মহাকাব্য, অভিবাসনের নির্মম অথচ বাস্তব চিত্রনাট্য।

১৫টি গল্পের চরিত্র ভিন্ন, কাহিনি-উপজীব্য ভিন্ন। কিন্তু প্লাটফর্ম এক এবং অভিন্ন। তাহলো ধর্ম এবং ধর্মবিশ্বাসী মানুষের বিভক্তি এবং সে বিভাজনের অনিবার্য অথচ চাতুর্যময় ফল দেশভাগ, দ্বিজাতিতত্তে¡র ভিত্তিতে দেশভাগ।

১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময়ে ছিল ৩০%; ১৯৭১ সালেও বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ২০% ছিল ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দু জনগোষ্ঠী। এখন সে সংখ্যা মাত্র ৮%। কোথায় গেল এই বিপুল সংখ্যক মানুষ? দেশত্যাগী সেই অসংখ্য মানুষের ভাগ্য বিড়ম্বনার বাস্তব কাহিনি নিয়ে এ বই; কবি ও কথাসাহিত্যিক ভজন সরকারের দেশত্যাগের গল্পগ্রন্থ “উত্তরের দেশে”। সপ্তর্ষি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে ২০২৪-এ ঢাকার একুশের বইমেলায়।

“পরিযায়ী জীবন”-এর বড় শিকদারের জীবনে ভাগ্য বিড়ম্বনা ব্যথিত করে পাঠকের মন। বাংলাদেশে অঢেল স্বচ্ছলতা ছেড়ে সা¤প্রদায়িকতার গেঁড়াকলে পড়ে পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে একেবারে নিঃস্ব হয়ে যায় বড় শিকদার। রিক্সাভ্যান চালিয়ে ন্যূনতম বেঁচেবর্তে থাকতেও পারে না এক সময়ের দুর্দোন্ড প্রতাপশালী ধণাঢ্য বড় শিকদার। ধর্ম আর সা¤প্রদায়িক রাষ্ট্রব্যবস্থার বলী লক্ষ-কোটি ধর্মীয় সংখ্যালঘু দেশত্যাগী হিন্দুদের প্রতিনিধি এই বড় শিকদার। অথচ এপার-ওপার কোনো বাংলাতেই এই মানুষগুলোর কথা লেখা হয়নি। লেখক ভজন সরকার সাহসের সাথে লিখেছেন, ধন্যবাদ সে জন্যেই।

“আটাশ বছর পরে” গল্পের বেনু শিক্ষক বাবার একমাত্র মেয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মেয়েকে রেখে ভারতে চলে যায় তাঁর পরিবার। আটাশ বছর পরে বেনু তাঁর বাড়িতে ফেরে। নিজের বাড়িটা এখন রাবেয়াদের। বেনু স্মৃতির সরণি বেয়ে চলে যায় সেই রাতে যে রাতে মা বেনুকে বাড়ি থেকে চলে যেতে সাহায্য করেছিল। খুব ভোরে বেনু বাড়ির গেইট দিয়ে চলে আসার সময় একটা ছায়ামূতি দেখেছিল। পরে মনে হয়েছিল সে ছায়া মূর্তিটি তাঁর মায়ের। আজও বেনুর মনে হচ্ছিল মা হয়ত আটাশ বছর পরেও বেনুকে দেখতে ছায়া মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু যখন বেনু দেখে সে ছায়াটি একটি গাছের, বেনু হু হু করে কেঁদে ওঠে। বেনুর কান্নায় পাঠকের মনও কেঁদে ওঠে দেশত্যাগের যন্ত্রণায় কাতর বেনুর মতোই।

“যুগল কাপালি” গল্পটি এক নিঃসন্তান দম্পত্তির টানাপোড়েনের গল্প। নিঃসন্তান মালতি তাঁর স্বামীর সন্তান দানের অক্ষমতাকে মেনে নিয়ে দেবরের সন্তান দু’টিকে নিজের সন্তান মনে করেই বেঁচে থাকে। হঠাৎ এক সকালে দেখে দেবরটি পাশের গ্রামের এক মুসলমানের কাছে জমি-বাড়ি বিক্রি করে তাঁর স্ত্রী-সন্তান নিয়ে দেশত্যাগ করেছে।

“শত্রু-সম্পত্তি” গল্পের ভবেশ প্রামানিকের মুক্তিযোদ্ধা ভাই নরেশ প্রামানিক একদিন নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। নরেশ প্রমানিক স্থানীয় এক রাজনৈতিক নেতার অত্যাচারের প্রতিবাদ করার পর থেকে তাঁর আর খোঁজ মেলে না। একদিন নরেশ প্রমানিকের সম্পত্তি শত্রæ সম্পত্তি হিসেবে ঘোষিত হয়। ভবেশ প্রামানিক বুঝতে পারে না, নিজের ভাই যে কিনা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করলো, যে বেঁচে আছে কিনা মরে গেছে সে সংবাদ নেই, সে কিভাবে দেশের শত্রæ হয়ে যায়?

“এখনও যোগেন মন্ডল” কিংবা “সেন নেত্রালয়” গল্পগুলো পড়তে পড়তে মনে হয় এ যেন বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর চালচিত্র এক চিত্রকর তাঁর নিপুন হাতে এঁকে যাচ্ছেন। স্মৃতিবিভ্রম দাদু কিংবা গৌর সেন সবাই যেন অনেক আগের দেশভাগ এবং সমসাময়িক উগ্র ধর্মীয় সা¤প্রদায়িকতার বাড়বাড়ন্তেরই নিখুঁত কাহিনি চিত্র।

“কাঁটাতারের এপার-ওপার” গল্পটি সীমান্তের দুই পাশের এক মর্মন্তুদ কাহিনি, যা লেখক নিজে সাংবাদিক না হয়েও এমনভাবে বর্ণনা করেছেন যে, মনে হয় এ যেন এক দক্ষ সাংবাদিকের অভিজ্ঞতার বর্ণনা। গল্পটি যেন আর গল্প থাকে না, তা হয়ে যায় আমাদের প্রতিদিন পড়া কোনো রহস্য-সাংবাদিকের সত্য উদঘাটনের কাহিনি। “৭১-এর খোঁজে” গল্পটি ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নে’য়া ভারতীয় সেনাবাহিনির নিহত এক ক্যাপ্টেনের পুত্র সন্তানের গল্প। দেবজ্যোতি তাঁর বাবা ১৯৭১ সালে কিভাবে নিহত হয়েছিলেন, কোথায় নিহত হয়েছিলেন সে সংবাদ সংগ্রহে আসে মুক্তিযুদ্ধের চার-পাঁচ দশক পরে। দেবজ্যোতির মৃত্যু পথযাত্রী মা তাঁর স্বামীর নিহতের খবর জেনে মরতে চান। দেবজ্যোতির সাথে এক সাংবাদিকের পরিচয় হয়। সে সাংবাদিক জানেন কিভাবে তাঁর বাবাকে খুন করেছিলেন তখনকার এক পাকিস্তানীপন্থী চেয়ারম্যান। অথচ সেই সাংবাদিক আজ ক্ষমতাসীন দলের বড় নেতা। দেবজ্যোতিকে তাঁর দেশের দূতাবাস সেই নেতার কাছেই পাঠায় তাঁর নিহত বাবার খবরের জন্য। সেই সাংবাদিক সত্য ঘটনা দেবজ্যোতির কাছে প্রকাশ করেন না। দেবজ্যোতিকে আর আঘাত দিতে চান না এ সত্য প্রকাশ করে যে, তাঁর বাবার মতো অসংখ্য মানুষ যে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন, সেই দেশ তাঁদের আত্মত্যাগকে আর তেমন মূল্যায়ন করে না, বরং তাঁর বাবার হত্যাকারীরা আজ দেশের ক্ষমতার কাছাকাছি বসে আছে।

“সুধীর যোশী”-র গল্পটি একটু ভিন্ন প্রেক্ষাপটের। ভারত থেকে প্রবাসী হয়ে আসা এক মানুষের জীবন সংগ্রামের গল্প, যে গল্প লেখককে অনুপ্রাণিত করেছিল। গল্পটি পাঠ করতে করতে পাঠক এশিয়া মহাদেশ ছাড়িয়ে চলে যান কানাডার এক আদিবাসী অধ্যুসিত এলাকায়। বিশ্বায়ণের এ গল্পে অভিবাসনের নানা দিক পাঠককে মুগ্ধ করে। এমন আরও দু’টি গল্প “গল্পের তুমি ও আশরাফ আল এলাহি” এবং “হঠাৎ আলোর ঝলকানি”। এ গল্প দু’টোর প্রেক্ষাপটও উত্তর আমেরিকা, যা পাঠকের ভালো লাগবেই।

ভজন সরকার যে একজন কবি সে প্রমাণ তাঁর কাব্যিক গদ্য লেখনিতে বোঝা যায়। পরের গল্পগুলো পাঠককে রবীন্দ্রনাথ থেকে পাবলো নেরুদা, শক্তি চট্রোপাধ্যায় থেকে সমরেশ মজুমদার ছুঁইয়ে আনে। দার্জিলিং -এর সৌন্দর্য, কখনও ডোয়ার্সের চা-বাগানের সবুজ, আদিবাসীদের মাদল কিংবা ঢাকার নিউ পল্টনের অঝর বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে পাঠকের মনও সিক্ত হয় ভালোবাসায়; সে ভালোবাসা প্রকৃতির প্রতি, মানুষের প্রতি এবং মানুষের বাসস্থান এ পৃথিবীর প্রতি।

তাই তো লেখক ভজন সরকার ফারাক্কা নদীর বাঁধের ওপর দিয়ে যেতে যেতে জলবন্টনের বৈষ্যমে ব্যথিত হোন। লেখকের মনে পড়ে তাঁর দেশ, তাঁর জন্মভুমি বাংলাদেশের কথা। লেখক ভজন সরকার বিশ্বাস করেন একদিন তাঁর বাংলাদেশও উন্নত হবে মনে-মননে। স্বাধীনতার এবং মুক্তিযুদ্ধের অসা¤প্রদায়িক চেতনায় আবার বাংলাদেশ জেগে উঠবে। কাজী নজরুল কিংবা রবীন্দ্রনাথ যে জাতির চেতনায় সে জাতিকে সীমান্তের কাঁটাতার দিয়ে কি বিভক্ত করা সম্ভব? তাই ভজন সরকারের “উত্তরের দেশে” গল্পগ্রন্থটি দেশত্যাগের গল্প হয়েও হয়ে উঠেছে এপার বাংলা – ওপার বাংলার স¤প্রীতি সূত্র। বইটি এক কথায় অসাধারণ এবং অনন্য সাধারণ। বইটি যে বাংলাসাহিত্যের এক অকথিত কিংবা স্বল্প-কথিত অধ্যায়কে উন্মোচন করেছে সে কথা নিশ্চিত করে বলা-ই যায়।

বই পরিচিতি
দেশত্যাগের গল্প “উত্তরের দেশে”
লেখক : কবি ও কথাসাহিত্যিক ভজন সরকার
প্রচ্ছদ : আল নোমান
প্রকাশক : শিবু ওঝা
প্রকাশনায় : সপ্তর্ষি
প্রাপ্তিস্থান : একুশে বইমেলা, ২০২৪, স্টল নম্বর ৬৮
Online E-mail Order : [email protected]
(Tel :088-01714-225520)

ডঃ সুকমল মোদক : বুয়েটের প্রাক্তন শিক্ষক, যুক্তরাষ্ট্র-প্রবাসী স্ট্রাকচারাল প্রকৌশলী, ভ‚মিকম্প বিশেষজ্ঞ, গবেষক এবং লেখক।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে