অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী স্মরণে

0
22

ভজন সরকার : বুয়েটে মনোযোগী ছাত্র ছিলাম না কোনোদিনই। এসএসসি ও এইচএসসি-তে রেজাল্ট ভালো হওয়াতে স্কলারশিপ নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন কিংবা ভারতের আইআইটি-তে পড়ব। তাই এইচএসসি পরীক্ষার পর বইপত্রের সাথে কোনোই সম্পর্ক ছিল না। বই ছিল ঢাকায়। আমি তখন মানিকগঞ্জের নদী-নালা-খাল-বিল-গাছ-গাছালি দেখতে ব্যস্ত।

বাবা পিজি হাসপাতালে একটি অপারেশনের জন্য ভর্তি। প্রায় সারারাত হাসপাতালে থেকে পরের দিন সকালে বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় বসলাম। সব কিছুই ঝাপসা-ঝাপসা মনে আসে কিন্তু পুরোপুরি কোনো ফর্মুলাই মনে আসে না। এভাবে তো বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষার মতো সর্বোচ্চ মেধার ছাত্রদের সাথে কম্পিটিশন করা যায় না। তবুও ভয় শূণ্য চিত্তে পরীক্ষা দিলাম।

ইতিমধ্যেই দেশের সব চেয়ে ভালো মেডিক্যালে ভর্তির সুযোগ হয়েছে কিন্তু মেডিক্যাল পড়ব না। বুয়েটের পরীক্ষাও ভালো হয়নি; ভর্তির আশা নেই, ইচ্ছেও নেই। আইআইটিতে স্কলারশিপ হলো কিন্তু তেমন ভালো সাবজেক্ট পেলাম না। সোভিয়েত ইউনিয়নের স্কলারশিপ হলো। যা’বার জন্য চূড়ান্ত প্রস্ততি।

এর মধ্যে বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট হলো। চান্স পেয়েছি কিন্তু মেধা তালিকার একেবারে শেষের দিকে। আমার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। এক আত্মীয়ের পরামর্শ মতো তবুও ভর্তি হয়ে রইলাম, যদি কোনো কারণে সোভিয়েত ইউনিয়নে যাওয়া না হয়। আসলে সেটাই হলো। ফ্লাইটের দু’দিন আগে মা বাধ সাধলেন। আশির দশকে আমার ইস্কুল শিক্ষক বাবার কষ্টার্জিত প্রায় ১৫-২০ হাজার টাকা বিনে কারণে অপব্যয়িত হলো। আমি বুয়েটেই পড়লাম কিন্তু ভর্তি পরীক্ষা খারাপের কারণে একেবারে নিচের দিকের মেধা তালিকায়।

নানা কারণে মাস তিনেক দুনোমুনো ক’রে সিদ্ধান্ত নিলাম বুয়েটেই পড়ব। টার্গেট ফার্স্ট ক্লাস। কিছুদিনের মধ্যেই বুঝলাম ফার্স্ট ক্লাস পেতে তেমন মনোযোগী হ’বার দরকার নেই। ক্লাস টেস্টগুলো ঠিকমতো দে’য়া আর প্রিপেরেটরি লিভে চোথা সংগ্রহ করে পড়লেই হলো। সেই মতোই কাজ।

প্রথম দুই বছর আমার যিনি রুমমেট তিনি আবার মহাফাঁকিবাজ, মহারিপিটার। তিন বছর পরীক্ষাই দেন না; একই ক্লাসে তিন বছর। বুয়েটে মোট আট বছর। বইপত্র কিচ্ছু নেই। একটি তেল চিটচিটে তোষক, একটি লেপ আর একটি বালিশ। গরমের দিনে উপরে আর শীতের দিনে লেপ আর তোষকের মাঝখানে। আমার অবস্থা এর চেয়ে একটু ভালো। একটি বিছানার চাদর আর একটি মশারী অন্তত আছে। বইপত্র আছে। কিন্তু ক্যালকুলেটর চোর কেনো জানি বুঝতে পেরেছে আমাদের অবস্থা। পরপর কয়েকবার চুরি হলো রুমে। চোর হলেরই বখে যাওয়া বড়লোকের ড্রাগ এডিক্ট ছেলে। কিন্তু ধরতে না পারলে তো কিছুই করার উপায় নেই।

শেষে আমরা দু’রুমমেট রুমে তালা দেওয়াই বন্ধ রাখলাম। এখনো মনে আছে, জানালার সাথে শক্ত রশি দিয়ে কলম বেঁধে রাখতাম। আর ক্লাসের চোথা রাখতাম টেবিলে। পরীক্ষার আগে সেই চোথা-কলম দিয়েই সারা রাত পড়ে পরীক্ষা। থার্ড ইয়ারে উঠে হিসেব ক’রে দেখলাম বুয়েট পাশ করলেই ফার্স্ট ক্লাস।

এর ফলে যা দাঁড়ালো, অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী (জে আর সি) এবং এরকম স্বনামখ্যাত স্যারেদের ক্লাসে শুধুই আসা-যাওয়া মাত্র। মনোযোগের বালাই নেই। ক্লাস টেস্টে উপস্থিত হলেই কিছু নম্বর; হোম-ওয়ার্ক এবং ফাইনাল পরীক্ষা। পাশ ঠেকায় কার সাধ্য!

তাছাড়া বুয়েটের শিক্ষা পদ্ধতি তখন এতোই আকর্ষণহীন এবং থিওরি নির্ভর ছিল যে, ক্লাস করা আর না-করার মধ্যে আমি তেমন ফারাক খুঁজে পাইনি। এখনো ভাবি, বুয়েটের শিক্ষকদের প্রায় সবাই বাইরের ভালো ভালো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষায় ডিগ্রিধারী। অথচ আর সবার মতোই পড়া শেষে এই শিক্ষকেরা যখন বিমানবন্দরে নামেন তখন বিদেশে শেখা সব কিছু ভুলে দেশীয় পদ্ধতির গড্ডালিকা প্রবাহে মিলে যান। একটি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবহারিক ও মানবিক শিক্ষার এতো অভাব যা ভাবতেই অবাক হই। অথচ কারও কোনো মাথাব্যথা নেই।

আজ যখন দেখি দেশের প্রধান প্রধান দুর্ণীতিবাজদের অনেকেই বুয়েট থেকে পাশ করা মেধাবী, তখন ভাবি কোথায় যেনো একটা গলদ আছে। বুয়েটের সাথে দুর্ণীতি, ধর্মান্ধতা এবং অপবিজ্ঞান-কুসংস্কার বিশ্বাসের কোথায় যেনো একটা যোগসূত্র আছে। সেটি এখনো আছে, তখনো ছিল।

যা হোক, অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী (জেআরসি) স্যারকে শিক্ষক হিসেবে তেমন মনে পড়ে না কিংবা দাগও কাটেনি তাঁর পড়ানো। বরং অন্য অনেক শিক্ষকের পড়ানোর স্টাইল ও পাঠদান প্রচন্ড ভালো লাগতো। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী (জেআরসি) স্যার ছিলেন বুয়েটের এক অন্যতম আইকন। যাঁর নাম ও খ্যাতি বুয়েট ছাড়িয়ে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। বিশেষ করে বুয়েট থেকে পাশ করার পরে কর্মক্ষেত্রে গিয়ে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী (জেআরসি) স্যারের খ্যাতির সাথে পরিচিত হতে শুরু করলাম। অত্যন্ত শান্ত সৌম্য দর্শনের অধ্যাপককে মিডিয়াতে দেখে এবং জ্ঞান-গর্ভ বক্তব্য শুনে নিজেও বেশ গর্বিত হ’তাম। একবার স্যারকে তত্ত¡াবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা করা হলো, যা বুয়েটের ছাত্র হিসেবে ছিল আমাদের গর্বের।

কিছুদিন পরেই প্রবাসী হলাম। বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ে যা পড়লাম সেগুলোই হলো চাকুরী ক’রে খাওয়ার রসদ। যমুনা নদীর উপর প্রথম যে দীর্ঘ সেতু, অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী (জেআরসি) স্যারকে করা হলো সেটির কারিগরি কমিটির চেয়ারম্যান। পদ্মা সেতুর টেকনিক্যাল কমিটির দায়িত্বেও স্যার। বেশ খুশী হ’তাম শুনে।

আজকাল বাংলাদেশের মানুষ মানবিকতার সহজ গুণাবলীগুলো যেনো ভুলে গেছে। তাই কতো উচ্ছ¡সিত হয়ে বলা হয়, স্যার খুব সৎ মানুষ ছিলেন। মানুষকে তো সৎ-ই হতে হয়। তাই সততা মানুষের কোনো গুণাবলী হওয়া উচিত নয়। অথচ অধিকাংশ অসৎ মানুষের দেশে সততাকেও একটি গুণাবলী হিসেবে ধরা হয়। সত্যিকার অর্থেই অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী (জেআরসি) ছিলেন একজন সৎ মানুষ, যা বাংলাদেশে আজ বিরলই বটে।

২০১৮ সালে বুয়েট এলামনাইদের এক অনুষ্ঠানে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যার আসবেন, একথা শুনে নাম রেজিস্ট্রি করলাম। স্যারের সাথে দেখা। সামনে গিয়ে নাম বললাম। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র ছিলেম সেটা বললাম। আমাকে অবাক ক’রে দিয়ে স্যার বললেন। “হা, তোমার নাম শুনেছি। তুমি বেশ ভালো লেখো। কিছু লেখাও তোমার পড়েছি”।

এরকম বললে খুব বিব্রত হই। স্যার বললেন, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তোমার লেখাটি বেশ ক’বার পড়েছি।
বুঝলাম, এলামনাইয়ের ম্যাগাজিনে ছাপানো রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরভাবনা প্রবন্ধটি স্যারের নজর কেড়েছে।

তখন লাইট রেল ট্রানজিট প্রকল্পে সিনিয়র বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করি। স্যার খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলেন কী কী কাজ করি। বললেন, বাহ, তোমাদের অনেকেই প্রফেশনেও সফল আবার লেখালেখিসহ সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডেও জড়িয়ে আছো।
আমেরিকাতে এক বন্ধু এবং আরেক জুনিয়র ছেলের কথা বললেন। আমি বললাম, স্যার ওদের সাথে পরিচয় আছে।

দেশে হোক কিংবা প্রবাসে, ইঞ্জিনিয়ারদের মধ্যে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারের জনপ্রিয়তা ব্যাপক। মুহূর্তেই অনেকেই চারিদিকে জড় হয়ে গেলো। আর কথা এগুলো না। স্যার জানেন ছবি তুলবো। স্যার এক পাশে দাঁড়ালেন। আমি একজনকে দিয়ে ছবি তুললাম দু’জনের। আরেকটা গ্রæপ ছবি।
দেশের উন্নযন প্রকল্পে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারের ছিল প্রবল আগ্রহ। যেকোনো মেগা প্রকল্পকে স্থায়ী, টেকসই এবং স্বল্পব্যয়ে নির্মানে তাঁর অবদান বাংলাদেশে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

পদ্মা সেতুসহ অনেক প্রকল্পে উপদেষ্টা হিসেবে স্যার জড়িত ছিলেন। সর্বগ্রাসী দুর্ণীতিতে ছেঁয়ে যাওয়া দেশে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর অভাব দেশ অনুভব করবে অনেকদিন।

জানি না, স্যারকে স্মরণ করার উপায় কী? অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর প্রাক্তন ছাত্রদের ফেইসবুকের পাতা ভরে গেছে তাঁর ছবিতে। অথচ এঁদের অধিকাংশই স্যারের আদর্শের ধারেকাছে নেই। বুয়েটের এই প্রাক্তন ছাত্রদের অধিকাংশ ঘুষখোর-দুর্নীতিবাজ কিংবা প্রচন্ড ধর্মান্ধ, সা¤প্রদায়িক এবং অপবিজ্ঞানে বিশ্বাসী; আধুনিকতা এবং মানবিকতার লেশমাত্র নেই অনেকের মধ্যেই। অথচ অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী ছিলেন আপাদমস্তক সৎ, আধুনিক, অসা¤প্রদায়িক এবং বিজ্ঞানমনস্ক এক মানবতাবাদী মানুষ।

২০২০ সালের ২৮ এপ্রিল অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী প্রয়াত হয়েছেন যেকোনো মৃত মানুষকে স্মরণ করার সর্বোৎকৃষ্ট পথ তাঁর আদর্শকে লালন করা। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীও তাঁর গুনাবলী ও আদর্শের মাধ্যমেই বেঁচে থাকবেন অসংখ্য মানুষের মনে। অপরিমেয় শ্রদ্ধা স্যারের স্মৃতির প্রতি।

(ভজন সরকার : কবি ও কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে