পহেলা বৈশাখ : শুভ নববর্ষ

0
24

ভজন সরকার : গত শতাব্দীর ৭০ এবং ৮০-এর দশকের বাংলাদেশ হঠাৎ পরিবর্তন হয়ে গেল ৯০ দশকেই। ৭১ সালে যুদ্ধে বিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন একটি দেশ। ৪৭ এর পরের সিকি শতাব্দী তো পশ্চিম পাকিস্তানী অবাঙালিদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতেই কেটে গেছে। ৭১ সালে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সাথে সাথে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উদ্ভাস ঘটলো বটে, কিন্তু সেই সাথে অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতাও সৃষ্টি হলো। ফলে কৃষ্টি-সংস্কৃতি উদযাপনের যে সামাজিক এবং পারিবারিক আনন্দ, তা রয়ে গেল প্রচ্ছন্ন।

রাজধানী ঢাকা তখনও সংস্কৃতির তীর্থভ‚মি। ঢাকার সাথে সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। সেই প্রায়-বিচ্ছিন্ন অবস্থায় কৃষ্টি-সংস্কৃতির নূতন উদ্ভাস দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তখনও পৌঁছেনি। ফলে বাঙালিপনার যে সাংস্কৃতিক উপকরণ এবং উদযাপন তা তখনও ছিল অঞ্চলভিত্তিকই। তাই তো সর্বজনীন আচার-অনুষ্ঠানগুলো ছিল কয়েকটি গ্রাম বা ইউনিয়ন বলয়ের মধ্যেই স্ব-স্ব মহিমায় ভাস্বর। অথচ অংশগ্রহণ বা আনন্দ-উদযাপন ছিল ধর্ম-বর্ণ এবং আঞ্চলিক পরিসীমার বাইরে পরিব্যাপ্ত।
কৃষ্টি-সংস্কৃতির এই যে বহুরূপীতা অথচ বৃহত্তর স্রোতধারার সম্মিলন, বাংলা এবং বাঙালির পরমত সহিষ্ণুতার শেকড় বোধহয় সংস্কৃতির গভীরে এমন করেই প্রোথিত। তাই তো হাজার বছরের নানান উত্তাল ডামাডোলেও বাঙালি আজো অনেক জাতিগোষ্ঠীর চেয়ে শান্তিপ্রিয়; অন্তত কয়েক দশক আগে পর্যন্ত তো অবশ্যই।

আজ ছায়ানট কিংবা চারুকলার যে বৈশাখী উদযাপন, ৭০ কিংবা ৮০ দশকেও সারা বাংলাদেশের কাছে তা ছিল অজানা। পাকিস্তান আমলে পহেলা বৈশাখ দূরে থাক, বাংলা গান তথা রবীন্দ্রনাথের গানকেও হিন্দুয়ানি তকমা লাগানোর চেষ্টা অব্যাহত ছিল। কারণ, পাকিস্তানীরা বুঝেছিল যে, বাঙালির অবিচ্ছিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে যদি বিভেদ রেখা সৃষ্টি করা যায়, তবে বাঙালি কখনোই আর স্বাধিকারের জন্য সংগঠিত হোতে পারবে না। তাই তো প্রথম আঘাত আসে ভাষার উপর ১৯৫২ সালে। ভাষার সে আঘাত বুকের রক্ত দিয়ে সেদিন প্রতিহত করা হয়েছিল।

সংস্কৃতির উপর সরাসরি আঘাত আসে আরও এক যুগ পরে ১৯৬১ সালে, যখন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রাণপুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশত বার্ষিকী উদযাপনের জন্য তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পী-সাহিত্যিকেরা একাট্টা হোন। পাকিস্তানী সরকার এক শ্রেণীর ধর্মান্ধদের খুব সুকৌশলে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য নিয়োজিত করেছিল। এই মৌলবাদী বুদ্ধিজীবিরা সাধারণ মানুষকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিল যে, রবীন্দ্রনাথ হিন্দু, তাই তাঁর জন্মশতবর্ষ পালন পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু মুসলমানের ধর্মীয় বিধানের পরিপন্থী।

১৯৫২ সালে ভাষার উপর আঘাত যেমন প্রতিহত করা হয়েছিল, ১৯৬১ সালেও তেমনি রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ পালনের বিরোধীতার নামে শিল্প-সংস্কৃতির উপর আঘাতও বাঙালি দৃঢ়ভাবেই প্রতিরোধ করেছিল। একথা বলা অত্যুক্ত হবে না যে, বাঙালি জাতিসত্ত¡ার জন্য একটি স্বাধীন ভ‚খন্ডের দাবী এই সব ঘটনার পরে আরও বেগবান হয়েছিল। আজ যারা স্বীকার করতে কুন্ঠাবোধ করেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলনের ভিত্তিমূল ছিল বাঙালির কৃষ্টি-সংস্কৃতি, তারা হয়ত ইতিহাস পরিক্রমার এ পাঠগুলো না জেনেই বলেন।

যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, প্রযুক্তি এবং অবকাঠামোর উন্নয়নের সাথে সাথে রাজধানীর আধুনিক এবং শহুরে সংস্কৃতি গ্রামে প্রবেশ করলো। যে গ্রামে বটগাছের চারিপাশে কিংবা হালোটে বৈশাখী মেলার আসর বসতো। গাঁজন গান হোতো। শরীরের ত্বকে বরশী আটকিয়ে চরোকের চারপাশে ঘোরানো হোতো। ধর্ম নির্বিশেষে কত রকমের সঙ সেজে বহুরূপী মানুষ গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতো। সেখানে দেখা গেল হাই-ভলিউমের গান, হাউজি-জুয়ার আসর। যে যাত্রাপালায় ছিল নির্ভেজাল আনন্দ, সেখানেও কৌশলে অশ্লীল নাচ ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। প্রথমে বাণিজ্যিক লাভের কথা বলা হলেও পরে দেখা গেল যে, এক শ্রেণীর রাজনীতিবিদ ধর্মীয় অনুভ‚তিকে কাজে লাগিয়ে সাধারণ মানুষকে উস্কে দিচ্ছে। যা ছিল আবহমান কালের, যা ছিল শাশ্বত, যা ছিল ধর্মীয় ভাবাবেগের বাইরের নির্মল আনন্দ, তার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে খেপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বিদেশী ভাষার ধর্মীয় গ্রন্থ থেকে ভুল-ভাল অনুবাদ করে ইচ্ছেকৃতভাবে হাজার বছরের সংস্কৃতিকে ধর্মের প্রতিপক্ষ বানানো হচ্ছে।
এক সময় শুধু মৌলবাদী ধর্মান্ধরা বাংলা-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে মানুষকে বোঝাতো। এখন দেখা যাচ্ছে প্রগতিপন্থী বলে যারা পরিচিত তারাও সংখ্যাধিক্যের লোভে ধর্মকে সংস্কৃতির বিরুদ্ধে দাঁড় করাচ্ছেন কিংবা চেষ্টা করছেন। হাজার বছর ধর্ম যেখানে জাতিসত্ত¡ার সংস্কৃতি-কৃষ্টি-ঐতিহ্যের সাথে পরিপন্থী হলো না, হঠাৎ করে কয়েক দশকের মধ্যেই কেনো এমনটি হলো? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার মাধ্যমেই একদিন বেরিয়ে আসবে সা¤প্রদায়িকতার রূপ-স্বরূপ।

শেকড় থেকে সমূলে উৎপাটিত হয়ে কোনো জাতিসত্ত¡াই টিকে থাকতে পারেনি এবং পারবেও না। বাঙালি জাতিসত্ত¡ার মূল হলো পহেলা বৈশাখের মতো সর্বজনীন উৎসবগুলো; যার ভিত্তিমূলে আছে আমাদের পূর্বপুরুষের জীবন ও জীবিকার ধারাবাহিক ইতিহাস ও নির্ঘন্ট। পহেলা বৈশাখ শুধু নতুন বছরের প্রথম দিন নয়। পহেলা বৈশাখ বাঙালি জাতিসত্ত¡ার বেড়ে ওঠার হালখাতা, যেখানে লেখা আছে অতীতের গৌরব এবং ভবিষ্যতে টিকে থাকার দীপ্ত অংগীকার। সবাইকে পহেলা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা।

(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, ওন্টারিও)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে