বড় বেদনার মতো বাজছে

0
40

ভজন সরকার: (১)
রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী সাদি মহম্মদের আত্মহনন নিয়ে কথা চলছেই। সোস্যাল মিডিয়া জুড়ে চলছে শোকের প্লাবন। আমি নিজেও অভিভ‚ত হয়েছি এতো মানুষের ভালোবাসা আর আবেগ দেখে। আহা। সাদি মহম্মদ যদি জানতেন এতো মানুষ তাঁকে ভালোবাসেন, তবে হয়ত তাঁর অবসাদ থাকতো না। হয়ত বাকী জীবনটাকে অন্যভাবে উদযাপন করতে পারতেন তিনি।
সাদি মহম্মদের আত্মহত্যার পরে তাঁর ভাই এবং গানের ছাত্র-ছাত্রীরা যা বলছেন, সেটা নিয়েও একটু ভাবনা-চিন্তা করা দরকার। একজন তো কেঁদে মিডিয়া ভাসালেন; সাদি মহম্মদ নাকি তাঁকে বলেছিলেন তিনি একুশে পদক না পেয়ে ভেংগে পড়েছিলেন। পদক না পেয়েই তিনি নাকি আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। তাঁর ছোট ভাই, যিনি এ বছরই একুশে পদক পেয়েছেন, নৃত্যশিল্পী শিবলি মহম্মদের কন্ঠেও একই সুর।
এই একুশে পদক পাওয়া কিংবা না-পাওয়া নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি থাকতেই পারে। একুশে পদক অপ্রাপ্তিই তাঁর অবসাদের অন্যতম কারণ, এ স্থুল মন্তব্য নিয়েও নানান কথা বলা হচ্ছে।

অনেকে বলছেন, একুশে পদক এমন কী পদক যা না-পেলে আত্মাহুতি দিতে হবে? সাদি মহম্মদের সম্মান কি সাধারণ মানুষ বিশেষকরে রবীন্দ্রসংগীতের মুগ্ধ শ্রোতাদের কাছে কম কিছু ছিল?
অনেকে বলছেন, একজন রবীন্দ্রানুরাগী মানুষের এমন ঠুনকো আবেগ কি মানায়? রবীন্দ্রনাথ থেকে তবে কী শিক্ষা পেয়েছিলেন সাদি মহম্মদ? যেখানে গীতবিতান পড়ে মানুষ ভুলে যায় দুঃখ, শোক আর জাগতিক অপ্রাপ্তি, সাদি মহম্মদ তো সারাজীবন সেই রবীন্দ্রনাথকেই মন-মননে ধারণ করেই বেঁচে ছিলেন। অথচ এই শেষ বয়সে বিচ্যূত হলেন রবীন্দ্রশিক্ষা থেকে?
আসলে সাদি মহম্মদের অবসাদের কারণ একমাত্র তিনিই বলতে পারতেন। অন্য যাঁরা বলছেন, তাঁরা অনুমান নির্ভর কথাই বলছেন। তবে সাদি মহম্মদের মতো এমন একজন সচেতন মানুষ রাষ্ট্র কিংবা প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতির জন্য আত্মহত্যার মতো কঠিন পথ বেছে নেবেন_ এ কথা জোর দিয়ে বলার আগে ভেবে দেখা দরকার নয় কি?

তবে এ কথা মানতেই হয়, সাদি মহম্মদের প্রতি প্রচন্ড অবিচার করা হয়েছে। বিশেষকরে একুশে পদক যাঁদের দেওয়া হয়েছে তাঁদের অবদানের সাথে সাদি মহম্মদের অবদান যদি তুলনা করা হয়, তবে একথা বলা যেতেই পারে যোগ্য স্বীকৃতি থেকে তাঁকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
কিন্তু কথা হলো, অবদান কিংবা প্রতিভার বিচারেই কি রাষ্ট্রের পদক পদবী মেলে? সমাজ থেকে রাষ্ট্র, রাষ্ট্র থেকে সরকার সবখানেই যেখানে তেলবাজি, দলবাজি এবং অসভ্যদের জয়জয়াকার, সেই সমাজে বাস করে সাদি মহম্মদের মতো এমন নিপাট গুণী ভদ্রলোকের স্বীয় প্রতিভার স্বীকৃতি প্রত্যাশা করাটাই বিশাল অন্যায় এবং অবাস্তব চিন্তা। সাদি মহম্মদ হয়ত ভুলে গিয়েছিলেন যে দেশের জন্য তাঁর পিতা শহীদ হয়েছিলেন সে বাংলাদেশ থেকে আজকের বাংলাদেশ যোজন দূরে। গণতন্ত্র থেকে সুশাসন, সংস্কৃতি থেকে শিক্ষা সব ক্ষেত্রেই আজ দুঃশাসনের রাজত্ব।

নিতান্তই কৌতুহলবশত আওয়ামী লিগ সরকারের আমলে কে কে সংগীতে একুশে পদক পেয়েছেন সে তালিকাটি দেখছিলাম। আওয়ামী লিগের সরকার বললাম এ কারণে যে, বিএনপি-জামায়াতের কাছে সাদি মহম্মদের মতো শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের কোন স্বীকৃতি প্রত্যাশা করাও তাঁদের পিতৃপুরুষের স্মৃতির প্রতি অবমাননা। তাছাড়া যে সরকারের শাসন আমলে প্রতিক্রিয়াশীল আমলা আসফ-উদ-দৌলা সংগীতে একুশে পদক (১৯৯৩ সালে) পান, সে সরকার কিভাবে সাদি মহম্মদকে একুশে পদক দেবেন?
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের দল আওয়ামী লিগ তাদের ২০ বছরে কা’দের সংগীত শিল্পকলায় একুশে পদক দিয়েছে সে তালিকা দেখেও চমকে উঠলাম এবং নিজেই হতাশ হলাম। শুধু রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী, যাঁরা পদক পেয়েছেন তাঁদের তুলনাতেও সাদি মহম্মদের অবদান অনেক এগিয়ে। কাউকে ছোট না করেও একটি তুলনা তো করাই যায়, তিনি কাদেরী কিবরিয়া। একমাত্র স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী এ পরিচয়টুকু বাদ দিলে বাংলাদেশে রবীন্দ্রসংগীত প্রসারে কী অবদান আছে এই ভদ্রলোকের। দীর্ঘ কয়েক দশক আমেরিকায় বাস করে বেইজমেন্টে জন্মদিন, বিবাহ বার্ষিকী, সুন্নতে খতনা কিংবা সমিতির অনুষ্ঠানে খেপ মারা (টাকা নিয়ে গান করা) ছাড়া বাংলাদেশে রবীন্দ্রসংগীত প্রসারে আর কী অবদান রেখেছেন?

এক কাদেরী কিবরিয়া কেন, গুগলে সার্চ দিলেই আওয়ামী লিগ সরকারের আমলে একুশে পদক প্রাপ্তদের তালিকাটা দেখতে পাবেন। বলুন তো, শুভ্র দেব, ডালিয়া নওশিন, ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, ফকির আলমগীরসহ আরও অনেক নাম, এমন কি প্রয়াত রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী মিতা হকের আগেও কি সাদি মহম্মদ একুশে পদক পেতে পারতেন না?
পাকিস্তানীদের দোসর ছিলেন সেই কবি তালিম হোসেনের মেয়ে শবনম মুশতারীকে সংগীতে একুশে পদক (১৯৯৭ সালে) দেওয়া যায় কিন্তু শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সলিমউল্লাহর সন্তান সাদি মহম্মদ তকিউল্লাহকে একুশে পদক দেয় না আওয়ামী লিগ সরকার।

আজ দেখলাম রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা আর চ্যানেল আই-য়ের ন্যাকামি। চ্যানেল আই এবং রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা এমন প্রভাবশালী যে, দেশের প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে লাইভ অনুষ্ঠানে টেলিফোন করিয়ে নিজের জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর মতো ক্ষমতা রাখেন তাঁরা। চ্যানেল আইয়ের মালিক পক্ষের শেকড়বাকর-লতাপাতা পর্যন্ত রাষ্ট্রের পদক পদবী বাগিয়ে নিয়েছেন অথচ সাদি মহম্মদের মতো এমন একজন নিভৃতচারী গুণী ও যোগ্য মানুষের জন্য সুপারিশ করতে পারেননি? আজ মৃত সাদি মহম্মদকে নিয়ে হইচই; দ্বিচারীতার একটা সীমা থাকা উচিত!

আসলে সাদি মহম্মদের আত্মহনন আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের অন্ধকার দিকটা উন্মোচন করে দিয়ে গেল। সংঘবদ্ধ এক দুষ্টচক্র বা সিন্ডিকেটের করালগ্রাসে আচ্ছন্ন আমাদের বাংলাদেশ। এই সিন্ডিকেট শিক্ষা থেকে সংস্কৃতি, কাঁচা বাজার থেকে মিডিয়া, প্রশাসন থেকে রাজনীতি সব জায়গায় দুর্দন্ড প্রতাপশালী। এদের প্রতিহত করবে কে? বরং সাদি মহম্মদের মতো হয়ত আরও অনেক গুণীজন অভিমানে অপমানে অবসাদের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে স্বেচ্ছা-অন্তরীণ থেকে থেকে রাগে-দুঃখে-ক্ষোভে একদিন চলে যাবেন না-ফেরার দেশে ।
সাদি মহম্মদের মৃত্যু আমাদের ব্যথিত করে, যূথবদ্ধভাবে লজ্জিত করে।

(২)
সাহিত্যিক শিবরাম চক্রবর্তীকে এক লোক জিজ্ঞেস করলেন, “দাদা, কেমন আছেন?”
স্বভাবসুলভ ভংগীতে শিবরাম চক্রবর্তী বললেন, “এই আছি, গতকাল যেমন ছিলাম।”
ভদ্রলোক তো অবাক, “গতকাল কেমন ছিলেন আমি কী করে জানবো আর জেনে বা কী করবো?”
শিবরাম বাবু বললেন, “আজকে কেমন আছি সেটি জেনেই বা কী করবেন?”
জনপ্রিয় রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সাদি মহম্মদের আত্মহত্যার খবর শুনে আর নানান জনের সাক্ষাৎকার শুনে শিবরাম বাবুর ওই কথাই মনে পড়ল। আহা, একেক জনের কী জ্বালময়ী আবেগ। অথচ সাদি মহম্মদ জীবিত থাকতে বছরে একবার খোঁজও হয়ত নেননি। হয়ত ভালো আছেন কিনা জানতেও চাননি! অথচ আজ মিডিয়া-বুমের সামনে বাইট দিচ্ছেন!

এক পোস্টে দেখলাম, এটি নাকি তাঁর আত্মহত্যার দ্বিতীয় প্রচেষ্টা। সেটিই যদি হয় তবে তাঁর পরিবারের লোকজন ও বন্ধু-বান্ধবদের উচিত ছিল তাঁর মানসিক চিকিৎসার। জানি না, কী এক বিষন্নতা থেকে এ রকম সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সাদি মহম্মদ। তবে যাই হোক না কেন, এটি দুর্ভাগ্যজনক ও অনাকাংখিত।
পৃথিবীতে কত মানুষ বেঁচে থাকার জন্য কী কষ্টই না করছে। যুদ্ধ থেকে, দুর্ভিক্ষ থেকে শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য পালিয়ে বেড়াচ্ছেন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। সাদি মহম্মদ নিজেও দেখেছেন ১৯৭১ সালে পাকিস্তানীরা তাঁর বাবাকে কী নির্মমভাবে হত্যা করেছে। সাদি মহম্মদ তাঁর ভাইবোনদের নিয়ে পালিয়ে এসে বেঁচে গেছেন। অথচ তাঁকেই গলায় ফাঁস লাগিয়ে নিজের জীবন নিজেকেই শেষ করে দিতে হলো। এটি সত্যি দুঃখজনক, মর্মন্তুদ ও হতাশজনকও।
মৃত মানুষকে নিয়ে এতো হইচই শুধুমাত্র নিজেদের জন্য। প্রয়াত মানুষটির এসবে কিচ্ছু যাবে-আসবে না। তবে সাদি মহম্মদের আত্মহত্যার পেছনের কারণ জানা জরুরী এ জন্যে যে, আমরা যেন আমাদের আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধব অনেকের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন হতে পারি।

মানসিক অবসাদ যে কোনো বয়সে যে কারোর দেখা দিতে পারে। মানসিক অবসাদ ধনী-গরিব-খ্যাতি-অখ্যাতির উপর নির্ভর করে না। পৃথিবীতে অসংখ্য খ্যাতিমান মানুষ আত্মহত্যা করেছেন; কবি জীবনানন্দ দাশ, বিখ্যাত সাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, লেখক ভার্জিনিয়া উলফ, বাংলা গানের বিখ্যাত গীতিকার পুলক বন্দোপাধ্যায় প্রমুখ।
আপনার আপনজনের কেউ মানসিক অবসাদগ্রস্থ হলে তাঁকে বা তাঁদেরকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান; এতে লজ্জার কিছু নেই। মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টিকে আমাদের দেশে একটা স্টিগমা বা লজ্জা হিসেবে দেখা হয়, যা সত্যি দুর্ভাগ্যজনক।
যারা বাংলাদেশে রবীন্দ্রসংগীতকে জনপ্রিয় করেছিলেন তাঁদের মধ্যে সাদি মহম্মদ অন্যতম। ৮০-এর দশকে শান্তিনিকেতন থেকে ৩ জন শিল্পী এসেছিলেন বাংলাদেশে; রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, সাদি মহম্মদ এবং আমিনুর রহমান নিঝু। নিঝু নিহত হয়েছিলেন রেল-সড়ক দুর্ঘটনায় আর সাদি মহম্মদ আত্মহত্যা করলেন।

শিল্পীসত্ত¡া ছাপিয়ে সাদি মহম্মদ ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সন্তান এবং মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের অসা¤প্রদায়িক, সংস্কৃতবান ও প্রগতিশীল মানুষ।
এরকম মানুষের হঠাৎ চলে যাওয়া ধর্মীয় মৌলবাদে জর্জরিত সা¤প্রতিক বাংলাদেশের প্রগতিশীল ও অসা¤প্রদায়িক মানুষের জন্য এক শূন্যতা।
বিনম্র শ্রদ্ধা সাদি মহম্মদের স্মৃতির প্রতি।

(ভজন সরকার : কবি ও কথাসাহিত্যিক)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে