আমার যতো বই

0
78

ভজন সরকার : “দেশত্যাগের গল্প : উত্তরের দেশে” বইটি বেশ ভালো পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে, জেনে খুশী হলাম। ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই পাঠিয়েছেন বইয়ের ফটো ও বই পাঠ-প্রতিক্রিয়া। এখনও যদিও আমি বইটি হাতে নিয়ে দেখিনি। তবে অনেকেই জানিয়েছেন, প্রায় নির্ভুল বানানেই বের হয়েছে বইটি। প্রচ্ছদ, কাগজ ও প্রকাশনার মানও উন্নত। শুনে খুশী হলাম। দেশের বাইরে থাকার এ এক বিড়ম্বনা; সময় মতো আনন্দের মুহূর্তগুলো ভাগ করে নে’য়া যায় না। তবু একজন পাঠকের ভালো লাগলেও আমার এ দীর্ঘদিনের অনিয়মিত এবং বিচ্ছিন্ন লেখালেখির প্রয়াসটুকু সার্থক। বই ছাপানোর অনীহা প্রায় স্থায়ী হয়েই থাকতো যদি না সপ্তর্ষির কর্ণধার তরুণ ও উদ্যমী প্রকাশক শিবু ওঝা আমার পেছনে নিরবিচ্ছিন্ন লেগে না থাকতেন।

২০২২ সালের সংক্ষিপ্ত বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছিল আমার উপন্যাস “চন্দ্রমুখী জানালা”। মুক্তিযুদ্ধ ও নকশাল আন্দোলন নিয়ে লেখা উপন্যাসটি আমার খুব প্রিয় একটি রচনা। আমার বাবার ছায়া-অবলম্বনে লেখা সে জন্যেই শুধু নয়, উপন্যাসটিতে ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর নেমে আসা অত্যাচার -নির্যাতনের কাহিনির বর্ণনা আছে, পশ্চিমবঙ্গের নকশাল আন্দোলনসহ সে সময়ের পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক চিত্রও তুলে আনার চেষ্টা করেছি। অনেকটাই ইতিহাস-নির্ভর উপন্যাস এটি।

“চন্দ্রমুখী জানালা” উপন্যাসটি যাঁরা পড়েছেন, তাঁদের অনেকেরই ভালো লেগেছে। তবুও আমার মনে হয়েছে উপন্যাসটি অনেক পাঠকের কাছে পৌঁছেনি, যা উপন্যাসটির জন্য বড় দুর্ভাগ্য। উপন্যাসটি পড়ে লেখক ও সংস্কৃতজন বেলাল ভাই (টেলিভিশনের বিখ্যাত প্রযোজক বেলাল বেগ) যে কত রকমের প্রশংসায় আমাকে অলঙ্কৃত করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। এই বয়সেও মুক্তিযুদ্ধের উপর বানাতে চেয়েছেন সিনেমা। ঢাকার আরেক প্রিয়জন কবি ও নির্মাতা মোয়াজ্জেম হোসেন তো রীতিমতো চিত্রনাট্যের সংলাপও লিখেছেন। জানি না, আয়ুর সীমানার কাছাকাছি পৌঁছানো মোয়াজ্জেম সাহেবের সে ইচ্ছে পূর্ণ হবে কিনা!

এক বিরুদ্ধ ও প্রতিক‚ল সময়ে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছে। একদিকে করোনা মহামারী, অন্যদিকে উপন্যাসটি প্রকাশের এক সপ্তাহের মধ্যেই প্রকাশক রঞ্জনদা (নন্দিতা প্রকাশের কর্ণধার বিভি রঞ্জন বেপারী) কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ফলে উপন্যাসটি প্রায় প্রচারহীন থেকেই অনেক পাঠকের হাতে পৌঁছেছে। লেখক হিসেবে আমার জন্যেও এ ঘটনাটি খুব শোকের ও দুঃখের। তাই বইটির ২য় সংস্করণ একদিন প্রকাশিত হবে, এ প্রত্যাশা নিয়েই আছি।

প্রথম বই “বিভক্তির সাতকাহন”-এর কথা অনেকেই মনে রেখেছেন; এখনও অনেকেই বলেন সে কথা; শুনে ভালো লাগে। প্রয়াত কবি হাবিবুল্লাহ সিরাজী এক অনুষ্ঠানে উচ্ছ¡সিত প্রশংসা করে বলেছিলেন, এক-বসায় কীভাবে তিনি বইটি মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়ে ফেলেছিলেন। বইটি নিয়ে প্রশংসা করেছিলেন প্রয়াত লেখক ও সংস্কৃতব্যক্তিত্ব মহসিন শস্ত্রপাণিসহ অনেকেই। জানি না, মুক্তচিন্তা প্রকাশনী দীর্ঘ ১৪ বছর পরেও বইটি স্টলে রাখেন কিনা?

প্রথম বই “বিভক্তির সাতকাহন”-এর প্রকাশনাও নানা ঘটনার মধ্যে দিয়ে ঘটেছিল। ২০১০ সালের কথা। কানাডা থেকে বাংলাদেশে গিয়েছি। অফিস থেকে চার সপ্তাহের ছুটি। পরিকল্পনা, দু’সপ্তাহ বাংলাদেশ আর দু’সপ্তাহ ভারতে বেড়াব। কী মনে ক’রে যেন কানাডা থেকে ভারতের ভিসা নিলাম না। ভাবলাম, বাংলাদেশে গিয়েই নেব।

তখন কী সব কারণে ভারতের ভিসা নিয়ে অনেক জটিলতা হচ্ছিল বাংলাদেশে। ভিসার জন্য গিয়েই শুনলাম যে, পাসপোর্ট যে দেশের সেখান থেকে ভিসা নিতে হবে (এখন যদিও বছরে তিনবার ই-ভিসাই দেয় ভারত!)। আমার মাথায় হাত! ভারতে বেড়ানোর সকল পরিকল্পনা আগেই করে রাখা। কবি-লেখক অনেক বন্ধু-বান্ধব ঢাকাতে। কবি বন্ধুরা কবি বেলাল চৌধুরীকে জানালেন। বেলাল ভাই তখন “ভারত বিচিত্রা”-র সম্পাদক। বেলাল ভাই শুনে জানালেন, এক বছর আগেও হ’তো কিন্তু এখন ব্যাপারটা একটু জটিল ক’রে ফেলেছে। তাছাড়া বাংলাদেশের পাসপোর্ট হ’লে তিনি করতে পারতেন।

আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের রুমমেট বড় ভাই পার্শ্ববর্তী দেশের রাষ্ট্রদূত। ফোন করলাম। শুনে উনি বলেন, “তুমি এখানে আস। এখানকার রাষ্ট্রদূতকে ব’লে ভারতের ভিসা করিয়ে দেব”। আমি বললাম, “এ তো মশা মারতে কামান দাগা। অতো সময় আমার নেই।”
সে বছরই আমার প্রথম বই “বিভক্তির সাতকাহন” বেরোবে মুক্তচিন্তা প্রকাশনী থেকে। প্রকাশক শেহাব ভাই বললেন, “দাদা ভারতে গিয়ে কাজ নেই। ২ সপ্তাহের মধ্যেই বইটি প্রকাশ ক’রে একটি প্রকাশনা উৎসব করি আপনার উপস্থিতিতে”।

আমার বন্ধু কবি ফরিদুজ্জামানের মহাউৎসাহ। ৪ সপ্তাহ ঢাকায় অলস সময় কাটিয়ে আবার ছাত্রজীবনের মতো আড্ডায় মেতে উঠেছিলাম সেবার। প্রতি বিকেলে শাহবাগ, টিএসসিতে আড্ডা। বন্ধুদের বাসা কিংবা অফিসে দিনভর আড্ডা। “বিভক্তির সাতকাহন” নিয়ে পাবলিক লাইব্রেরিতে বেশ জমজমাট একটি প্রকাশনা উৎসব। অনেকেই উপস্থিত ছিলেন সে প্রকাশনা উৎসবে। সভাপতিত্ব করেছিলেন বিশিষ্ট লেখক ও সংস্কৃতি-ব্যক্তিত্ব মহসিন শস্ত্রপাণি (মহসিন ভাই গত বছর আমাদের ছেড়ে চিরকালের জন্যে চলে গেছেন)। ছিলেন কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী, কবি মতিন বৈরাগী, কবি প্রাবন্ধিক রতন মাহমুদ, কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন, কবি ফরিদুজ্জামান, কবি ও কলামিস্ট বিলু কবীর, কবি তপন বাগচী, কবি আবুল হাসনাত মিল্টন, কবি সৌমিত্র দেবসহ আমার অসংখ্য বন্ধু-বান্ধব ও গুণীজন।

তারপর আরও তিনটা বই আরেক প্রকাশনা থেকে বের হয়েছে। আজ একজন জানতে চাইলেন, নন্দিতা থেকে প্রকাশিত বই “বাঁশে প্রবাসে” পাওয়া যায় কিনা। আরও দু’টো বই “নন্দিতা প্রকাশনী” বের করেছিল, “রেড ইন্ডিয়ানদের সাথে বসবাস” এবং “ক্যানভাসে বেহুলার জল (কাব্য)”। বইগুলোও আরেক প্রতিক‚ল সময়ে প্রকাশিত হয়েছিল, ২০১৩ সালের সেই গণজাগরণের সময়ে। সন্তানের বেড়ে ওঠার স্মৃতিময় দিনগুলোর মতোই একজন লেখকের কাছে তাঁর লেখালেখির স্মৃতিও হৃদয়ে স্থায়ী দাগ কেটে থাকে আমৃত্যু; আমারও তেমনি আছে। পুনশ্চ- “চন্দ্রমুখী জানালা” উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল এক শারদীয় সংখ্যায়। সম্পাদনা করেছিলেন ভারত বিচিত্রার প্রাক্তন সম্পাদক নান্টু রায়। বাংলাদেশ সরকারের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ওয়েব পেইজে উপন্যাসটি এখনও আছে। উত্তরের দেশের গল্পগুলোও দেশ-বিদেশের নানা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
(ভজন সরকার : কবি ও কথাসাহিত্যিক।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে