সুশীলরা সমাজে কীভাবে মৌলবাদ ছড়ায়

0
59

ভজন সরকার : (১)
“বাংলাদেশে ভালো লেখক নেই …”
২০১২ সালের একটি জনপ্রিয় সিনেমা ‘টেলিভিশন’। রচনায় আনিসুল হক, প্রযোজনা ও পরিচালনায় মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী। খুব জনপ্রিয় হয়েছিল সিনেমাটি। একটি গ্রামীন সমাজ কিভাবে আধুনিক প্রযুক্তির সাথে সাথে পরিবর্তিত হচ্ছে খোলা চোখে এই হচ্ছে সিনেমাটির কাহিনি। আসলেই কি তাই? আসুন, শুধুমাত্র একটি সিকোয়েন্সের কথা ভাবি।
গ্রামের হুজুর ফতোয়া দিয়েছেন, টেলিভিশন দেখা ইসলাম সম্মত নয়। তাই কেউ টেলিভিশন দেখতে পারবে না। বিপত্তিটা ঘটলো গ্রামের এক হিন্দু মাস্টার বাড়ির টেলিভিশন সেট নিয়ে। হিন্দু-মুসলমান সবাই ওই হিন্দু মাস্টারের বাড়িতে গিয়ে টেলিভিশন দেখে। হুজুর মহাবিপদে পড়ে গেলেন। পরে ধর্মীয় বিধান ঘেটে দেখলেন, অমুসলিমদের রক্ষা করা এবং তাদের হক আদায়ের স্বাধীনতা দেয়ার কথা ধর্মেই বলা আছে। ফলে, হুজুর ওই হিন্দু মাস্টারকে আর শাস্তি দিলেন না।

স্বভাবতই দর্শক খুব সরল দৃষ্টিতে ভাববেন এই সিকোয়েন্স নিয়ে আপত্তির কী আছে? সাধারণ মানুষের এই সহজ ও সরল ভাবনার সুযোগটিই অনেকদিন ধরেই নিচ্ছেন আনিসুল হক- মোস্তফা সরোয়ার ফারুকীসহ প্রথম আলো সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠী। এখানে চাতুরীটা হলো, ওই হিন্দু মাস্টারের টেলিভিশন দেখার যে একটি নাগরিক অধিকার আছে, যা রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত, সেটি পাশ কাটিয়ে এই দুষ্টুচক্র একটি ধর্মকে মহান করে দেখালেন। দেখালেন যে, ধর্মীয় সংখ্যালঘু একজনকে শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা সংখ্যাগুরু ধর্মীয় নেতার আছে। আসলে খুশী করলেন এবং উস্কে দিলেন এক শ্রেণীর ধর্মান্ধদের।
অথচ একজন নাগরিকের অধিকারের জন্য ধর্মগ্রন্থ কেন নির্দেশনা দেবে? বিশেষ করে বাংলাদেশে যেখানে সংবিধানই ধর্ম- নির্বিশেষে সব নাগরিককে এ অধিকার দিয়েছে, সেখানে আনিসুল হক- ফারুকী গং কেন ধর্মের কাছে এ অধিকারের স্বীকৃতি খুঁজলেন? আনিসুল হক- ফারুকীসহ প্রথম আলো গং-য়ের এই প্রয়াস দীর্ঘদিন থেকেই চলছে।

এ ধরণের দুষ্টুবুদ্ধির প্রয়োগ ও ব্যবহার মাধ্যমভেদে বদল হয়। নাটক-সিনেমায় চরিত্রের আড়ালে খুব সুক্ষ্ণভাবে ঢুকিয়ে দে’য়া হয় এগুলো। পত্রিকায় সংবাদ বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও ঘটে এর ব্যবহার; তুচ্ছ ঘটনাকে মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব দে’য়া এবং গুরুত্বপূর্ণ সংবাদকে লঘু করে প্রকাশ করা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। গল্প-উপন্যাসের ক্ষেত্রেও ঘটে এমন। লক্ষ করে দেখবেন, প্রথম আলো এবং প্রথমার মতো প্রকাশনী আঁটঘাট বেঁধে এমন কিছু লেখককে প্রমোট করতে থাকেন যাঁরা এই গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করেন। অনেক উদাহরণের মধ্যে অন্যতম হলো এবারের বইমেলায় স্বাধীনতাবিরোধী এবং প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত আসিফ নজরুলের লেখা একটি কথিত উপন্যাসের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবসা।
আজ অনেকেই বাংলাদেশে ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে প্রগতির মুখোশের আড়ালের এই মৌলবাদের দোসরদের এড়িয়ে যান। ওই অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত ওয়াজিদের চেয়ে এই শ্রেণী আরো বেশি ভয়ঙ্কর। কারণ, এঁদের বিচরণ সবখানে। এঁদের ক্যামোফ্লাজ বড় বিচিত্র; কখন কোন রঙ নেয় তা চিন্তার অতীত।

তাই, আজ যখন বন্ধুবর লেখক-সাংবাদিক আনিসুল হক বলেন, “বাংলাদেশে ভালো লেখক নেই বললেই চলে”, তখন ভাবতে হয়, এ কথার পেছনে না জানি কী কুবুদ্ধি লুকিয়ে আছে!
প্রথম আলো পত্রিকার উচ্চপদে আসীন এবং ফারুকীর অনেক দুর্বুদ্ধির পেছনের মানুষটির মুখে হঠাৎ এ আত্মোপলব্ধি? ঢাকার বইমেলায় পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের বই রাখার বিরোধী কুশীলবদের একজনের হঠাৎ কলকাতার ‘দাদা’-দের প্রতি এমন লুংগিকচ্ছ প্রশংসা? তবে কি প্রথম আলোর ঘরের মানুষ আসিফ নজরুলের কাছে বাংলার তথাকথিত ম্যাক্সিম গোর্কী সাহেবের বই-ব্যবসায় ধরাশায়ী হয়ে “দাদা-দের ধুতির কচ্ছ ধরার পায়তারা”?

দীর্ঘদিন থেকেই প্রথম আলোগং নানা কৌশলে দলমত নির্বিশেষে সা¤প্রদায়িক ও ধর্মীয় মৌলবাদী মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে প্রয়াসী হয়েছে; খুব দুঃখের সাথে বলতেও হয়, সফলও হয়েছে। তাই এবার “বকরনামা”-র লেখক সফল হয়েছেন, আগামী বছর আরেক আসিফ নজরুলকে তৈরী করবে প্রথম আলো ও প্রথমা গোষ্ঠী। তখনও কৃত্রিম উষ্মা প্রকাশ করে আনিসুল হকরা আরও বিধ্বংসী বয়ান দেবেন।

আমরা বুঝি না-বুঝি, আনিসুল হক-আসিফ নজরুলরা যে ভেড়ার পালের জন্যে লেখেন, প্রথম আলো যাদের জন্য সংবাদ ছাপেন কিংবা ফারুকীরা যে গোষ্ঠীর জন্য সিনেমা-নাটক বানিয়ে থাকেন, তারা কিন্তু আনিসুল হকের এই সুক্ষ্ণ চাতুরী ঠিকই বোঝেন। যতোই “বড় আপা”, “ছোট আপা” কিংবা “বঙ্গবন্ধু” বলে বক্ষ ভেজান না কেনো, তাঁদের ওই ভেড়ার পালের স্বাধীনতাবিরোধী ও সা¤প্রদায়িক মুগ্ধ পাঠকেরা কিন্তু ঠিকই জানে, “তোমরা আমাদেরই লোক।”

(২)
তাজমহল নির্মাণ ও ড. সলিমুল্লাহ খান বিতর্ক
ড. সলিমুল্লাহ খান ঝাঁকের কৈ হোতে পছন্দ করেন। ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে মুসলমানের গুনগান করে বিখ্যাত হোতে পছন্দ করেন। গরুকে নদীতে নামিয়ে নদী রচনা লিখতে পছন্দ করেন। আর তার জন্য অর্ধ-সত্যকে রঙচং দিয়ে পুরো সত্য বানাতে পছন্দ করেন।
সলিমুল্লাহ খানের এ প্রচেষ্টা দীর্ঘদিনের। একটু সেক্যুলারবিরোধী, একটু রবীন্দ্রবিরোধী, একটু হিন্দুবিরোধী কথাবার্তা ইতিহাসের নানা সঙ্কলন থেকে ‘চেরি-পিকিং’ করেন। এসব বিতর্কিত বিষয়কে এমনভাবে ‘সুগার কোটিং’ করেন যে, তা যেন দেশের ধর্মীয় সংখ্যাগুরু মানুষের ধর্মীয় অনুভ‚তির পক্ষে যায়।

আগে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বলেছিলেন, মাদ্রাসা শিক্ষা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কনসেপ্ট এসেছিল বলেছিলেন; ইদানিং বলেছেন তাজমহল নিয়ে। তাজমহল নাকি আগ্রার কওমী মাদ্রাসায় পড়া শিক্ষিতরা বানিয়েছিল! কথাটির পক্ষে ইতিহাস-নির্ভর কোনো যুক্তি-প্রমাণই নেই। অথচ মনের মাধুরী মিশিয়ে পশ্চাদপদ একটা শিক্ষা ব্যবস্থাকে গেøারিফাই করলেন।
যখন সলিমুল্লাহ খান বলেন মাদ্রাসা শিক্ষা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কনসেপ্ট এসেছে, তখন তিনি ভুলে যান তাঁর অবস্থানের মাত্র কয়েক শ’ কিলোমিটারের মধ্যে খৃষ্টিয় ৫ম শতাব্দীতেই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। খৃষ্টিয় ৫ম শতাব্দীতে কি মাদ্রাসার কনসেপ্ট ছিল?
স্থপতি, নকশাকরসহ বিশাল এক দক্ষ জনগোষ্ঠী তাজমহল নির্মাণের সাথে জড়িত ছিল। প্রধানত, পারস্য এবং ওটোম্যান সাম্রাজ্যের দক্ষ নকশাকারেরা তাজমহল নির্মাণের সাথে জড়িত ছিলেন। এঁদের প্রায় সবার নামই ছিল আরবি কিংবা পার্সী; হোতে পারে, এঁদের অনেকেই ধর্ম বিশ্বাসে মুসলমানও ছিলেন। কিন্তু এঁরা সবাই মাদ্রাসা থেকে স্থাপত্য শিক্ষা পেয়েছিলেন সে ইতিহাস কি প্রমাণিত?

প্রায় ৩৭ জন স্থপতি, নকশাকার এবং ডিজাইনারের নাম পাওয়া যায় যাঁরা তাজমহল নির্মাণের নানা অংশের সাথে জড়িত ছিলেন।। উল্লেখ্য এর মধ্যে বেশ কয়েক জন আছেন অমুসলিম। এঁদের মধ্যে একজনের নাম চিরাঞ্জি লাল, যিনি দিল্লীর বিখ্যাত মোজাইক শিল্পী ছিলেন। হাজার হাজার শ্রমিকও কাজ করেছেন তাজমহল নির্মাণে। সলিমুল্লাহ খান কি বলবেন সবাই মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত, এমন কি চিরাঞ্জি লালও?
আসলে সলিমুল্লাহ খান আলোচনায় থাকতে পছন্দ করেন। ভেড়ার পালের সাথে হাঁটতে পছন্দ করেন। বিখ্যাত সব ইতিহাসবিদ বা লেখকদের রচনার পৃষ্ঠা এবং লাইন মুখস্থ করে এসে রেফারেন্স দেন। প্রতিটি টক শো বা বক্তৃতার আগে এ রকম ‘হট টপিক’ মুখস্থ করে এসে গরগর করে আওড়ে যান। সাদা চোখে আমদর্শক-আমশ্রোতা তাক লেগে যান।

আসলে সলিমুল্লাহ খানরা যা করেন, যুক্তি বিদ্যায় তার নাম ‘লজিক্যাল ফালাসি’ বা কুযুক্তি। নিজের মত প্রতিষ্ঠার জন্য বা নিজের সুবিধে মতো একটা জিনিসের প্রাধান্য দেওয়ার জন্য এ রকমটা করা হয়। তাজমহলের শ্রমিকরা মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত ছিল, এরকমটি বলে বলার চেষ্টা যে, মাদ্রাসা শিক্ষা উৎকৃষ্ট। সলিমুল্লাহ খান কিন্তু মাদ্রাসায় পড়ান না বা পড়েননি। তাঁর সন্তানদের বা নিকট আত্মীয়স্বজনের সন্তানদের কাউকে মাদ্রাসায় পড়িয়েছেন বলেও মনে হয় না। অথচ ৯০ ভাগ মুসলমান অধ্যুষিত দেশে মাদ্রাসা শিক্ষাকে গেøারিফাই করে বিপুল সংখ্যক ধর্ম-প্রাণ মানুষের সহানুভ‚তি পেতে চান।
একই চেষ্টা করে গেছেন আহমদ ছফা, যাঁকে সলিমুল্লাহ খান গুরু হিসেবেই মানেন। আসলে এ মানুষগুলো দ্বিচারী মানুষ। জনপ্রিয়তা পেতে সংখ্যাগুরু মানুষের ধর্মীয় অনুভ‚তিকে কাজে লাগান। অথচ এই ধর্মপ্রাণ মানুষগুলোর মঙ্গলের কথা, ভালোর কথা একটুও চিন্তা করেন না।

ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা মানুষগুলোর ভন্ডামি খোলা চোখে ধরা যায়। কিন্তু এই সব দ্বিচারী লেখক-বুদ্ধিজীবিদের সুক্ষ্ণ-অপকর্ম একটি জাতিগোষ্ঠীর পিছিয়ে পড়া মানুষকে আরও পেছনে ঠেলে দেয়।

(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে